নিউট্রন স্টার, মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য শক্তির গোপন রহস্য।

নিউট্রন স্টার, মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য শক্তির গোপন রহস্য।

নিউট্রন স্টার, মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য শক্তির গোপন রহস্য।

ভূমিকা

মহাবিশ্বে অসংখ্য বিস্ময়কর ও রহস্যময় বস্তু রয়েছে, যার মধ্যে নিউট্রন স্টার অন্যতম। এটি একটি মৃত নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশ, যেখানে পদার্থ এতটাই ঘন হয়ে থাকে যে, এর মাত্র এক চামচ পদার্থের ওজন কয়েক বিলিয়ন টন হতে পারে! নিউট্রন স্টার শুধু ঘনত্বের দিক থেকেই নয়, এর শক্তি, মাধ্যাকর্ষণ এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক থেকেও মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয় এই বিস্ময়কর বস্তু? কেনই বা এটি এত শক্তিশালী? এই আর্টিকেলে আমরা নিউট্রন স্টারের রহস্য উন্মোচন করব এবং এর বৈশিষ্ট্য, গঠন প্রক্রিয়া এবং মহাবিশ্বে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

 নিউট্রন স্টার কী?

নিউট্রন স্টার হলো একটি অতিঘন বস্তু, যা একটি বিশাল নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তার কেন্দ্রীয় অংশ সংকুচিত হয়ে তৈরি হয়। এটি এতটাই ঘন যে, এর ব্যাস মাত্র ১০-১৫ কিলোমিটার হলেও এর ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। নিউট্রন স্টারের অভ্যন্তরে পদার্থ এতটাই সংকুচিত হয়ে থাকে যে, ইলেকট্রন এবং প্রোটন একত্রিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়। এই কারণে এর নাম "নিউট্রন স্টার"।

নিউট্রন স্টার কীভাবে তৈরি হয়?

নিউট্রন স্টার তৈরি হয় একটি বিশাল নক্ষত্রের জীবনের শেষ পর্যায়ে। সাধারণত, যেসব নক্ষত্রের ভর সূর্যের চেয়ে ৮-২০ গুণ বেশি, তারা তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে যায়। এই বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশ সংকুচিত হয়ে নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। নিচে এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলো:

   ১. হাইড্রোজেন ফিউশন

নক্ষত্রের জীবন শুরু হয় হাইড্রোজেন ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি নক্ষত্রকে স্থিতিশীল রাখে এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে কাজ করে।

   ২. ভারী মৌলের ফিউশন

সময়ের সাথে সাথে নক্ষত্রের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যায় এবং হিলিয়াম ফিউশন শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় কার্বন, অক্সিজেন এবং অন্যান্য ভারী মৌল তৈরি হয়। শেষ পর্যায়ে নক্ষত্রের কেন্দ্রে লোহার একটি কোর গঠিত হয়।

   ৩. সুপারনোভা বিস্ফোরণ

যখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে লোহার কোর তৈরি হয়, তখন ফিউশন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। লোহার কোর আর শক্তি উৎপন্ন করতে পারে না, ফলে নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে কেন্দ্রীয় অংশ হঠাৎ সংকুচিত হয়। এই সংকোচনের ফলে একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে, যা নক্ষত্রের বাইরের স্তরকে মহাকাশে ছিটকে ফেলে।

   ৪. নিউট্রন স্টার গঠন

সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশ সংকুচিত হয়ে একটি নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। এই সংকোচনের সময় প্রোটন এবং ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়। ফলে নিউট্রন স্টারের অভ্যন্তরে প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিউট্রন দ্বারা গঠিত একটি অতিঘন পদার্থের গোলক তৈরি হয়।

নিউট্রন স্টারের বৈশিষ্ট্য

নিউট্রন স্টারের কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটিকে মহাবিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর বস্তু করে তোলে। নিচে এর কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:

   ১. উচ্চ ঘনত্ব

নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে, এর মাত্র এক চামচ পদার্থের ওজন প্রায় ১০০ কোটি টন হতে পারে! এই ঘনত্বের কারণে নিউট্রন স্টারের অভ্যন্তরে পদার্থের অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে পদার্থ এতটাই সংকুচিত হয়ে থাকে যে, এটি একটি "নিউট্রনিয়াম" নামক অতিঘন অবস্থায় পৌঁছায়।

   ২. প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ

নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। এর মাধ্যাকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে, এটি আশেপাশের স্থান-কালকে বিকৃত করে ফেলে। এই ঘটনাটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়।

   ৩. শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র

কিছু নিউট্রন স্টার, বিশেষত ম্যাগনেটার (Magnetar) নামে পরিচিত প্রকারগুলো, মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে ১০০ ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী হতে পারে!

   ৪. দ্রুত ঘূর্ণন

অনেক নিউট্রন স্টার প্রতি সেকেন্ডে হাজার বার ঘূর্ণন করতে পারে। এই দ্রুত ঘূর্ণনশীল নিউট্রন স্টারগুলোকে পালসার (Pulsar) বলা হয়। পালসারগুলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর শক্তিশালী রেডিও সিগন্যাল নির্গত করে, যা মহাকাশে একটি বাতিঘরের মতো কাজ করে।

পালসার: মহাকাশের কসমিক বাতিঘর

পালসার হলো এক ধরনের নিউট্রন স্টার, যা দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকে এবং নিয়মিত বিরতিতে শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ নির্গত করে। ১৯৬৭ সালে জোসেলিন বেল বার্নেল এবং অ্যান্থনি হিউইশ প্রথম পালসার আবিষ্কার করেন। পালসারগুলোর এই নিয়মিত সিগন্যাল নির্গমনের কারণে এগুলোকে মহাকাশের "কসমিক বাতিঘর" বলা হয়। পালসারগুলো মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে মহাকাশের দূরত্ব পরিমাপ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গবেষণায়।

নিউট্রন স্টার বনাম ব্ল্যাক হোল

নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাক হোল উভয়ই সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তৈরি হয়। তবে এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো তাদের ভর। যদি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রের অবশিষ্ট ভর সূর্যের ভরের ৩ গুণের বেশি হয়, তাহলে এটি একটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। অন্যদিকে, যদি ভর এই সীমার মধ্যে থাকে, তাহলে এটি একটি নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে, এটি আলোককেও নিজের মধ্যে আটকে ফেলে, যেখানে নিউট্রন স্টার থেকে আলো এবং অন্যান্য বিকিরণ নির্গত হতে পারে।

মহাবিশ্বে নিউট্রন স্টারের গুরুত্ব

নিউট্রন স্টার মহাবিশ্বের বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সময়ের সাথে পরিবর্তন এবং সুপারনোভা বিস্ফোরণের প্রভাব মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন তথ্য দিতে পারে। নিউট্রন স্টার এবং পালসারগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, পদার্থের চরম অবস্থা এবং মহাবিশ্বের প্রসারণ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারেন।

উপসংহার

নিউট্রন স্টার শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও এক বিস্ময়ের বস্তু। এর অপার শক্তি, রহস্যময় প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের বিবর্তনে এর ভূমিকা এটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তুলেছে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা নিউট্রন স্টারের আরও নতুন তথ্য উন্মোচন করবেন, যা মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনে আমাদের আরও এক ধাপ এগিয়ে নেবে। নিউট্রন স্টার মহাবিশ্বের একটি জীবন্ত প্রমাণ যে, প্রকৃতি কতটা বিস্ময়কর এবং জটিল হতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন