পৃথিবীর ১০টি ভয়ঙ্করতম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, যা মানব ইতিহাসকে নাড়িয়ে দিয়েছিল
বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে সহজ ও উন্নত করলেও কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা মানব ইতিহাসে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব পরীক্ষার উদ্দেশ্য কখনো ছিল অজানা জ্ঞান আহরণ, কখনো সামরিক আধিপত্য বিস্তার, আবার কখনো নিছক নিষ্ঠুর কৌতূহল। তবে সব ক্ষেত্রেই পরীক্ষাগুলো ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছে।
এখানে আমরা এমন কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সম্পর্কে জানবো, যা পৃথিবীকে হতবাক করেছিল।
১. দ্য স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট (১৯৭১)
মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ জিম্বারডো’র নেতৃত্বে এই পরীক্ষা পরিচালিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দুই দলে ভাগ করা হয়—এক দলকে কয়েদি এবং অপর দলকে কারারক্ষী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে বলা হয়।
পরীক্ষাটি কয়েক সপ্তাহ চলার কথা থাকলেও মাত্র ছয় দিনের মাথায় বন্ধ করতে হয়। কারণ কারারক্ষীরা এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে যে, কয়েদিদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন শুরু করে।
এই পরীক্ষা প্রমাণ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা ভয়ংকর হতে পারে।
২. দ্য মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্ট (১৯৬১)
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্ট্যানলি মিলগ্রাম এই পরীক্ষা করেন, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্য একজনকে ভুল উত্তরের জন্য ইলেকট্রিক শক দিতে বাধ্য হতেন।
যদিও শকটি আসল ছিল না, তবে অংশগ্রহণকারীরা তা জানতেন না। দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের আদেশ মানতে গিয়ে নৈতিকতা ভুলে অন্যদের কষ্ট দিতে রাজি হয়ে যায়।
এই পরীক্ষা মানুষের আনুগত্য ও নিষ্ঠুরতার এক ভয়াবহ দিক প্রকাশ করে।
৩. দ্য ইউনিট ৭৩১ পরীক্ষা (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ)
জাপানের সামরিক গবেষণাগার "ইউনিট ৭৩১" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভয়ঙ্কর মানব পরীক্ষার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে।
এখানে বন্দিদের ওপর জীবাণু অস্ত্র, অত্যধিক শীতলতা, বিষাক্ত রাসায়নিক ও অন্যান্য নির্মম পরীক্ষা চালানো হতো।
হাজার হাজার মানুষ এসব পরীক্ষার শিকার হয়ে প্রাণ হারায়।
৪. দ্য লিটল অ্যালবার্ট এক্সপেরিমেন্ট (১৯২০)
এই পরীক্ষা পরিচালনা করেন জন ওয়াটসন ও রোজালি রেইনার। এখানে একটি শিশুকে (লিটল অ্যালবার্ট) বিভিন্ন নিরীহ প্রাণী যেমন—সাদা ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
প্রথমে শিশুটি প্রাণীগুলোকে ভয় পেত না, কিন্তু পরে যখনই সে প্রাণীগুলোর কাছে আসত, তখনই উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করা হতো।
ফলে শিশুটি ভয় পেতে শুরু করে এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত সে পশুদের প্রতি অস্বাভাবিক আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে ওঠে।
৫. দ্য হেড ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্ট (১৯৫০-এর দশক)
সোভিয়েত বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির ডেমিখভ ১৯৫০-এর দশকে দুটি কুকুরের মাথা একসঙ্গে সংযুক্ত করে ভয়ংকর এক পরীক্ষা করেন।
কুকুরটি কিছু সময় বেঁচে ছিল, তবে পরে এটি মারা যায়।
এই পরীক্ষাটি পরবর্তী সময়ে মাথা প্রতিস্থাপনের গবেষণাকে উৎসাহিত করলেও এটি নৈতিকভাবে বিতর্কিত ছিল।
৬. দ্য সিরিন কন্ট্রোল এক্সপেরিমেন্ট (২০০২)
একটি কম পরিচিত কিন্তু ভয়ঙ্কর পরীক্ষা হলো ‘সিরিন কন্ট্রোল এক্সপেরিমেন্ট’।
রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা এমন একটি রাসায়নিক তৈরি করেছিলেন, যা মানুষের অনুভূতি ও ইচ্ছাশক্তি দমন করতে পারে।
যদিও এ সম্পর্কে খুব কম তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তবে গুজব রয়েছে যে এটি মানুষের মনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৭. ট্রিনিটি নিউক্লিয়ার টেস্ট (১৯৪৫)
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিনিটি নিউক্লিয়ার টেস্ট।
এটি ছিল বিশ্বের প্রথম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ, যা ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে পরিচালিত হয়।
বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষার আগে নিশ্চিত ছিলেন না যে, বিস্ফোরণের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অগ্নিশিখা ছড়িয়ে গোটা গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে কি না।
তবুও তারা পরীক্ষা চালায় এবং এর ফলে পারমাণবিক যুগের সূচনা হয়।
৮. দ্য ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট (১৯৪৩)
দাবি করা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনী একটি গোপন পরীক্ষা চালায়, যা "ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট" নামে পরিচিত।
এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজকে রাডারের দৃষ্টিসীমার বাইরে অদৃশ্য করা।
কথিত আছে যে, USS Eldridge নামক যুদ্ধজাহাজে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফলে জাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
যদিও এই পরীক্ষার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবুও এটি এখনও রহস্যময় রয়ে গেছে।
৯. দ্য টাস্কিগি সিফিলিস স্টাডি (১৯৩২-১৯৭২)
যুক্তরাষ্ট্রের "টাস্কিগি সিফিলিস স্টাডি" ছিল ইতিহাসের অন্যতম অনৈতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
এখানে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মানুষদের বিনা চিকিৎসায় রেখে সিফিলিস রোগের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়।
রোগীদের জানানো হয়নি যে তাদের শরীরে সিফিলিস রয়েছে। ৪০ বছর ধরে চলা এই গবেষণার ফলে অসংখ্য মানুষ মারা যায়।
১০. সের্নের গ্রেট হ্যাড্রন কোলাইডার (২০০৮-বর্তমান)
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক গ্রেট হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) চালু হওয়ার সময় কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, এটি হয়তো ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর (Micro Black Hole) সৃষ্টি করতে পারে।
যদিও এখন পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি, তবুও এই পরীক্ষাগুলো চালিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
উপসংহার
বিজ্ঞান মানবজাতির উন্নতির জন্য অপরিহার্য, তবে কিছু পরীক্ষা এমন মাত্রায় চলে গেছে যেখানে নৈতিকতা, মানবিকতা ও নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
অতীতের কিছু ভয়ঙ্কর গবেষণা আমাদের শিখিয়েছে যে, অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিক সীমারেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানীরা যখন নতুন পরীক্ষা চালান, তখন এই ইতিহাস মাথায় রাখা জরুরি, যাতে মানবসভ্যতা অন্ধকারের পথে না হাঁটে।